বরিশাল প্রতিনিধি: ভেঙে পড়েছে বরিশাল বিশ্ববিদ্যালয়ের (ববি) চেইন অব কমান্ড। অভিভাবকহীন হয়ে পড়ায় বিশ্ববিদ্যালয়টিতে গত কয়েক মাস ধরে স্থবিরতা বিরাজ করছে। উপাচার্য না থাকায় থমকে গেছে এখানকার অ্যাকাডেমিক ও উন্নয়ন কার্যক্রম। কর্মকর্তা, শিক্ষকদের মধ্যে প্রকট দ্বন্দ্ব আর সংঘাত সামলাতে পারছেন না উপাচার্য পদে রুটিন দায়িত্বে থাকা ট্রেজারার অধ্যাপক ড. এ কে এম মাহবুব হাসান। তার ওপর আইন বহির্ভূতভাবে প্রায় ১২ কোটি টাকার বিল উত্তোলনেরও অভিযোগ উঠেছে ট্রেজারারের বিরুদ্ধে।
মাসের পর মাস অর্থ কমিটি, অ্যাকাডেমিক কাউন্সিল সর্বপরি সিন্ডিকেটের সভা না হওয়া সত্ত্বেও কোনো এখতিয়ার বলে ক্ষমতাহীন ট্রেজারার কোটি কোটি টাকা খরচ করেছেন তা নিয়ে প্রশ্ন দেখা দিয়েছে সর্বমহলে। উদ্ভূত অস্থিরতায় ববিতে একজন পূর্ণাঙ্গ উপাচার্যের দাবিতে সোচ্চার হয়ে উঠেছেন ছাত্র, শিক্ষক, কর্মকর্তা, কর্মচারীসহ সুশিল সমাজও। গত ২৮ মে থেকে বরিশাল বিশ্ববিদ্যালয় উপাচার্যের পদ শূন্য রয়েছে।
জানতে চাইলে বরিশাল বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্যের রুটিন দায়িত্বে থাকা ট্রেজারা অধ্যাপক ড. এ কে এম মাহবুব হাসান বলেন, পূর্ণাঙ্গ উপাচার্য দেওয়ার বিষয় সরকারের। তবে তার দায়িত্ব পালনে কোনো সমস্যা নেই। বিশ্ববিদ্যালয়ের অভ্যন্তরীণ দ্বন্দ প্রসঙ্গে তিনি বলেন, একজন কর্মকর্তার লিখিত অভিযোগ পেয়েছেন। পাল্টা অভিযোগও দেওয়া হয়েছে। ক্যাম্পাসের দেয়ালে দেয়ালে শিক্ষক, কর্মকর্তাদের নিয়ে আপত্তিকর মন্তব্য প্রসঙ্গে তিনি বলেন, সেগুলো দেয়াল থেকে মুছে ফেলা হয়েছে। শিক্ষক, কর্মকর্তাদের মধ্যে এমন বিরোধ তিনি সংবাদ মাধ্যমে প্রকাশ না করারও অনুরোধ জানান।
ট্রেজারার বলেন, বিল দেওয়ার বিষয়ে নানা বাধ্যবাধকতা ও আইন আছে। যেসব বিল দেওয়া হয়েছে তা নিয়ম অনুযায়ী। প্রকল্প পরিচালকের মেয়াদ শেষ হলেও পদে বহাল থাকা প্রসঙ্গ তিনি এড়িয়ে গেছেন।
ববির সাবেক উপাচার্য অধ্যাপক ড. এস এম ইমামুল হককে অপসারণে মাসের পর মাস আন্দোলনের অন্যতম ছিলেন বিশ্ববিদ্যালয় ছাত্র মো. লোকমান হোসাইন। বৃহস্পতিবার তিনি নতুন উপাচার্য চেয়ে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে পোস্ট দিয়েছেন। তাতে উল্লেখ করেছেন, টানা ৫ মাস উপাচার্যবিহীন বরিশাল বিশ্ববিদ্যালয়। দায়িত্ব পালনকারী ট্রেজারারের সীমাবদ্ধতা থাকায় তিনি সকল দায়িত্ব পালন করতে পারছেন না। এ অবস্থায় শিক্ষার্থীদের যৌক্তিক দাবি ও বিশ্ববিদ্যালয় স্থাপনা সংক্রান্ত কাজ পিছিয়ে পড়েছে। শিক্ষার্থীরাও অনেক কাজে জটিলতার সম্মুখীন হচ্ছে। নতুন উপাচার্য নিয়োগ ব্যতীত ববির গতিশীলতা সৃষ্টি হবে না। ওই ছাত্রের এমন স্ট্যাটাস গ্রহণ করেছেন ১২৩ জন ছাত্র, শিক্ষক, কর্মকর্তা, কর্মচারী। জানা গেছে, ভেতরে ভেতরে ছাত্র-ছাত্রীরা পূর্ণাঙ্গ ভিসির দাবিতে একাত্ত হচ্ছে।
বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষা কার্যক্রম ভেঙে পড়ায় শিক্ষকদের মধ্যে বিরূপ প্রতিক্রিয়া দেখা দিয়েছে। বরিশাল বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক সমিতির সাধারণ সম্পাদক সহকারী অধ্যাপক আবু জাফর মিয়া বলেন, পূর্ণাঙ্গ ভিসি না থাকায় বিশ্ববিদ্যালয়ের অ্যাকাডেমিক, অর্থ ও সিন্ডিকেট সভা হয় না দীর্ঘ মাস ধরে। এর ফলে সিলেবাস, ফল কার্যত অনুমোদন দেওয়া যাচ্ছে না। খণ্ডকালীন শিক্ষকও নিয়োগ হচ্ছে না। অনেকটা জোড়াতালি দিয়ে কাজ চলছে। এর ফলে উন্নয়ন থমকে আছে। বিল হচ্ছে না। প্লানিংও হচ্ছে না। সর্বোপরি একটি বিশ্ববিদ্যালয়ের ভিসন, মিশন অচল হয়ে পড়েছে। বিশ্ববিদ্যালয়ের চেইন অব কমান্ড এমনভাবে নাজুক হয়ে পড়েছে যে শিক্ষকদের বিরুদ্ধে ক্যাম্পাসের দেয়ালে বাজে মন্তব্য করা হচ্ছে। তিনি বিশ্ববিদ্যালয়ের এমন স্থবিরত কাটিয়ে তুলতে একজন পূর্ণাঙ্গ ভিসি নিয়োগের দাবি তুলেছেন।
এ দিকে, গত সাড়ে ৫ মাসে বিশ্ববিদ্যালয়ের পরিচালনায় অনেকটাই ব্যর্থ হয়ে পড়েছেন ট্রেজারার ড. এ কে এম মাহবুব হাসান। তার মেয়াদও শেষ হচ্ছে আগামী অক্টোবরে। ট্রেজারারের দুর্বলতার সুযোগ নিয়ে যে যার মত দায়িত্ব পালন করছেন কর্মকর্তারা। যেকারণে উন্নয়ন কার্যক্রম যেমন মুখ থুবড়ে পড়েছে, তেমনি বিরোধ চরম আকার ধারণ করেছে। জানতে চাইলে বরিশাল বিশ্ববিদ্যালয়ের নির্বাহী প্রকৌশলী ও অফিসার্স অ্যাসোসিয়েশনের সভাপতি মো. মুরশীদ আবেদীন বলেন, ভিসি না থাকায় বিশ্ববিদ্যালয়ের অবস্থা খুবই নাজুক হয়ে পড়েছে। ভেতরে ভেতরে বিরোধ জেঁকে বসেছে। বিশ্ববিদ্যালয়ের সহকারী পরিচালক সুব্রত কুমার বাহাদুরকে গত ২৪ সেপ্টেম্বর লাঞ্ছিত করেছেন কর্মকর্তা আতিকুর রহমান। লাঞ্ছিতের শিকার সুব্রত রুটিন দায়িত্বে থাকা ভিসির কাছে লিখিত অভিযোগ দিয়েছেন। কর্মকর্তা আতিক অনেককেই এভাবে নাজেহাল করছেন ট্রেজারার এর প্রশ্রয় পেয়ে। আতিক টিএসসির দায়িত্বে ছিলেন। অথচ কোনো আদেশ ছাড়াই তাকে অর্থদপ্তরে বসানো হয়েছে। ট্রেজারারের ইশারায় আতিকুর রহমান পছন্দের লোকদের কেবল বিল দিচ্ছেন। অনেকেরই বিল আটকে দিচ্ছেন তিনি। ফাইলও ফেরত পাঠাচ্ছেন নিয়ম বর্হিভূত।
নির্বাহী প্রকৌশলী মুরশীদ আবেদীন বলেন, ট্রেজারার অধ্যাপক ড. এ কে এম মাহবুব হাসান রুটিন দায়িত্ব পালন করছেন উপাচার্যের। অথচ ক্ষমতা না থাকা সত্ত্বেও তিনি অনিয়ম করে ১০ থেকে ১২ কোটি টাকার বিল উত্তোলন করেছেন। যেমন কম্পিউটার, প্রজক্টের ক্রয় বাবদ ৭০ লাখ টাকার বিল করেছেন। রুটিন দায়িত্বে থেকে ড. মাহবুব হাসান এখতিয়ার বহির্ভূত কোটি কোটি টাকা খরচ করতে পারেন না। বিশ্ববিদ্যালয়ের উন্নয়ন প্রকল্পের প্রকল্প পরিচালক আবুল বাশার এর মেয়াদ ৩০ জুন শেষ হয়েছে। অথচ এখনও মন্ত্রণালয়ের অনুমতি ছাড়াই বহাল তবিয়তে রয়েছেন তিনি। এমন মারাত্মক অনিয়ম ট্রেজারার প্রশ্রয় দিচ্ছেন।
ফলে উন্নয়ন থমকে রয়েছে। কর্মকর্তাদের এই নেতা বলেন, সম্প্রতি ক্যাম্পাসের দেয়ালে দেয়ালে দেয়ালে কর্মকর্তা-শিক্ষকদের বিরুদ্ধে ন্যাক্কারজনক মন্তব্য করা হয়েছে। তাতে উল্লেখ করা হয়েছে, ‘আমি সাবেক ভিসি ইমামুল হকের পা চাটা দালাল, আমার মুখে থুথু দিন।’ এর কোনো বিচার না হওয়ায় শিক্ষক ও কর্মকর্তাদের মধ্যে ক্ষোভ ও অস্থিরতা বিরাজ করছে।
এ প্রসঙ্গে বিশ্ববিদ্যালয়ের সহকারী পরিচালক (অর্থ) ও অফিসার্স অ্যাসোসিয়েশনের সাধারণ সম্পাদক আতিকুর রহমান বলেন, অর্থ শাখায় একটি চিঠি নিয়ে কথা কাটাকাটি হয়েছে সুব্রতর সঙ্গে। এ নিয়ে আমিও লিখিত দিয়েছি তার বিরুদ্ধে। এর আগেও জীবননাশের হুমকি দেওয়ায় আমি জিডি করেছিলাম।
তিনি বলেন, অনেকের বিল না ছাড়ার কারণ আছে। অনেকটাই ভুয়া বিল। বিশেষ করে নির্বাহী প্রকৌশলী মুর্শিদ আবেদিন অনেক ভুয়া বিল করেছেন। তিনি বলেন, কিছু বিল ছাড়া হচ্ছে, তবে তা বিতর্কিত বিল নয়। তিনি মনে করেন, ট্রেজারারকে দুর্বল পাওয়ায় যে যার মতো দায়িত্ব পালন করছেন। পূর্ণাঙ্গ ভিসি থাকলে এমন জটিলতা ও অস্থিরতা বিশ্ববিদ্যালয়ে থাকত না।
সম্মিলিত সামজিক আন্দোলন বরিশাল জেলা সাধারণ সম্পাদক কাজী এনায়েত হোসেন শিবলু বলেন, বরিশাল বিশ্ববিদ্যালয় বরিশালবাসীর আন্দোলনের ফসল। তার কন্যাও এই বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থী। কিন্তু এখানে এখন নানা শ্রেণির মানুষ এসে রাম রাজত্ব চালাচ্ছে। যারা এখন দায়িত্ব পালন করছেন তারা শিক্ষার দিকে মনোযোগ না দিয়ে অর্থ ভাগভাটোয়রায় ব্যস্ত। বিশ্ববিদ্যালয়ের এর প্রভাব পড়ছে শিক্ষার্থীদের ওপর। অচল অবস্থা কাটাতে তিনি প্রধানমন্ত্রীর হস্তক্ষেপ কামনা করছেন।
প্রসঙ্গত, আন্দোলনের কারণে চলতি বছরের ২৭ মে দায়িত্ব থেকে বিদায় নেন সাবেক উপাচার্য অধ্যাপক ড. এস এম ইমামুল হক। ২৮ মে থেকে উপাচার্য পদ শূন্য হয়ে পড়ে বিশ্ববিদ্যালয়টিতে।